চট্টগ্রাম বন্দরে আড়াই বছর ধরে পড়ে আছে কবির স্টিল রি-রোলিং মিলস (কেএসআরএম) গ্রুপের ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় পদার্থভর্তি একটি কনটেইনার। আমদানি করা পুরনো লোহা-লক্কড়ের সঙ্গে থাকা কনটেইনারটি ঝুঁকিতে ফেলেছে গোটা এলাকাকে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন দুই বছর আগে কনটেইনারটি কেএসআরএম কর্তৃক্ষকে সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিলেও প্রতিষ্ঠানটি তা আমলেই নেয়নি। এমনকি চট্টগ্রাম কাস্টম ও বন্দর কর্তৃপক্ষ বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও কেএসআরএম কনটেইনারটি সরিয়ে নিতে সময়ক্ষেপণ করে চলেছে।
জানা গেছে, লেবাননের বৈরুত বন্দরের দুর্ঘটনার পর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ঝুঁকি এড়াতে বিপজ্জনক ধাতব বস্তু অপসারণে তৎপরতা শুরু করেছে। গঠন করা হয়েছে কমিটি। ঝুঁঁকি এড়াতে কেএসআরএমের কনটেইনারটিসহ আরও দুটি বিপজ্জনক ধাতব বস্তু যে কোনো মূল্যে অপসারণ করতে চায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নানা জটিলতায় তা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ বস্তুগুলো দ্রুত সরানো না হলে বন্দরসহ পুরো চট্টগ্রাম ঝুঁকিতে পড়বে। ফলে এবার আর ছাড় দেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে কাস্টম ও বন্দর কর্তৃপক্ষ। কনটেইনার চালানটি পুনঃরপ্তানি অথবা ধাতব বস্তুটি আলাদা করে স্থানীয় পর্যায়ে নিষ্পত্তি করতে এক মাস সময় বেঁধে দিয়েছেন চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মো. ফখরুল আলম। বন্দর সূত্র জানায়, সিঙ্গাপুরের ভ্যালেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং প্রাইভেট লিমিটেড থেকে পুরনো লোহার
টুকরো আমদানি করে কেএসআরএম গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান কেএসআরএম বিলেট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠানটি পুরনো এই লোহা এনেছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলি থেকে। ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর চালানটি খালাসের সময় বন্দরের সিপিআর গেটে মেগাপোর্ট ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের ‘রেডিয়েশন পোর্টাল মনিটরে’ সংকেত বাজে। এর পরই কনটেইনারটি আটক করে দ্বিতীয় ধাপে পরীক্ষা করা হয়। ওই বছরের ১০ নভেম্বর কনটেইনারটিতে চালানো হয় তৃতীয় ধাপে জরিপ। পরমাণু শক্তি কমিশনের ছয় সদস্যের একটি পরিদর্শক দল জরিপ করে কনটেইনারের ভেতর তেজস্ক্রিয় পদার্থের স্থানটি চিহ্নিত করে।
জানা গেছে, তিন ধাপে পরীক্ষা করে লোহার পণ্যে তেজস্ক্রিয় পদার্থের উপস্থিতি নিশ্চিত হন বিজ্ঞানীরা। লোহার মধ্যে পাওয়া তেজস্ক্রিয় মৌলটি ‘সিজিয়াম ১৩৭’। এর সর্বোচ্চ মাত্রা পাওয়া গেছে প্রতি ঘণ্টায় ১ দশমিক ২৩ মাইক্রোসিভার্ট (তেজস্ক্রিয়তা পরিমাপের একক)। শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় পদার্থ হলো দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষতিকর পদার্থ। এটি সরাসরি মানুষের সংস্পর্শে এলে বা গলিয়ে কোনো পণ্য প্রস্তুত করে ব্যবহার করলে মানবস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের ঝুঁঁকি তৈরি হতো।
কনটেইনারটি নিয়ে করণীয় বিষয়ে গঠিত কমিটির আহ্বায়ক পরমাণু শক্তি কমিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা একেএম সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়া আমাদের সময়কে বলেন, লোহার মধ্যে পাওয়া তেজস্ক্রিয় মৌলটি ‘সিজিয়াম ১৩৭’। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এটি কনটেইনার থেকে বের করা সম্ভব নয়। তাই তদন্ত কমিটি কনটেইনারটি পুনরায় রপ্তানির সুপারিশ করেছে। কাস্টম কর্তৃপক্ষ বলছে, চালানটি রপ্তানি করতে গেলে বিষয়টি আরও জটিল হবে। তাই এখন নিষ্পত্তি করতে হবে স্থানীয় পর্যায়ে।
অভিযোগ রয়েছে, পরমাণু শক্তি কমিশন থেকে কনটেইনারটি পুনঃরপ্তানির পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নানা অজুহাতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম সেটি আড়াই বছর ধরে বন্দরে ফেলে রেখেছে। ফলে এখন আর পুনঃরপ্তানির সুযোগ নেই।
চট্টগ্রাম বন্দরে মেগাপোর্ট ইনিশিয়েটিভ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, মাবিয়া স্টিলের রপ্তানিপণ্যের একটি চালানে ২০১৪ সালে, বিএসআরএম ও সিটাডেলের রপ্তানি চালানে ২০১৭ সালে তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে দেয় কাস্টম কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল শেখ আবুল কালাম আজাদ আমাদের সময়কে বলেন, বৈরুতের দুর্ঘটনার পর সারাবিশ্ব এখন সতর্ক। তাই আমরাও ঝুঁকিপূর্ণ পদার্থ সরাতে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছি। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কাস্টম কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এবার আর ছাড় দেওয়া হবে না।
চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মো. ফখরুল আলম বলেন, তেজস্ক্রিয় পদার্থ দুভাবে নিষ্পত্তি করা যায়। চালানটি পুনরায় রপ্তানি করা অথবা স্থানীয় পর্যায়ে নিষ্পত্তি করতে হয়। কেএসআরএম ও বিএসআরএম কর্তৃপক্ষকে এক মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে বলেছি। ঢাকার সাভারে পরমাণুু শক্তি কমিশনের ইউনিটে ধ্বংস করতে হবে। এ জন্য আমদানি ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় ব্যয় বহন করবে।
Leave a Reply